রেহনুমা খানম...বয়স পঞ্চাশোর্ধ..চোখের জলে এখন চশমা ঝাপসা হয়ে ওঠে। তখন শাড়ির আঁচল দিয়ে চশমার কাঁচ মুছেন। পড়ন্ত সন্ধ্যাবেলায় বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ফেলে আসা দিনগুলোর মাঝে হারিয়ে যান তিনি। কৈশোরের সেই রোমাঞ্চময় স্মৃতি এখনও শিহরিত করে তোলে রেহনুমাকে।
রাজশাহীর অদূরে রসূলপুর নিরিবিলি সুন্দর একটি গ্রাম। গ্রামের একপাশ বয়ে চলেছে প্রমত্তা নদী পদ্মা। তখন পদ্মানদী এখনকার মত ধূধূ মরুভূমি ছিলনা। পদ্মার গর্জনে গমগম করত সারা গ্রাম। এই গ্রামের মিষ্টি মেয়ে রেহনুমা। পাঁচ ভাই-বোনের তিনি ছিলেন সবার বড়। বাবা পাশের হাই স্কুলে পড়াতেন। দাদার জমি-জায়গার কোন অভাব ছিলনা। তিনি চাইতেন বাবাই যেন সবকিছুর দেখভাল করে, কিন্তু বাবার বিষয়-সম্পত্তিতে কোন নজর ছিলনা-শুধু স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করতেন।
এদিকে মা আমাদের পাঁচ ভাই-বোনকে সামলানোতে ব্যস্ত থাকতেন। পিঠাপিঠি পাঁচ ভাই-বোন আমাদের খুনসুটি লেগেই থাকত। কেউ এটা নিবো বলে জেদ ধরলে অন্যরাও জেদ ধরত। মা পড়ে যেতেন বিপাকে। এভাবে আমাদের দিনগুলো ভালই কেটে যাচ্ছিল। মাঝখান থেকে কীহয়ে গেল, সবার কপালে চিন্তার ছাপ পড়ল। বড়রা সময় পেলেই আলোচনায় বসে যেত, বাবা স্কুল ঘরে কীসব মিটিং করে ফিরত। দাদা জানতে পেরে বাবাকে খুব বকাবকি করতে লাগল, বলল কেন তুমি নেতাগিরি শুরু করেছ, নিজ দেশে থেকে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছ, অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছ। কী করতে চাও তোমরা...মুক্তিযুদ্ধ। এই নিয়ে বাবা-দাদার মধ্যে তর্ক চলতে লাগল।
এমন সময় পাশের বাড়ির আব্দুল কাকা খবর দিল, গ্রামে মিলিটারী ঢুকেছে। বড়দের কথা আমরা কিছুই বুঝতে পরতাম না। মাকে প্রশ্ন করতাম, মুক্তিযুদ্ধ কী? মা অবুঝ চোখে শুধু তাকিয়ে থাকতেন। বলতেন দেশে যে কী অশান্তির আগুন জ্বলে উঠল, ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে কোথায় গিয়ে উঠব।
ওদিকে মিলিটারীরা স্কুল ঘরে ক্যাম্প করলো। তারপর শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ... দাদার নিষেধ থাকা সত্ত্বেও বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলো। বাবা চলে গেলে মা ভীষন একা হয়ে পড়ল। এদিকে দাদা অনিচ্ছা সত্ত্বেও, গ্রামের মেম্বার জোর করে দাদাকে শান্তিকমিটিতে নাম লিখতে বাধ্য করলো।
পুরো গ্রামটা প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে ওঠল। আশে-পাশের সবাই গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে লাগল। মা একা আর কুলিয়ে উঠতে পারলেন না। দাদার কাছে অনুমতি নিয়ে, আমাদের সবাইকে নিয়ে নানীবাড়ির দিকে রওনা হল। নৌকো করে নদী পার হওয়ার সময়, মার চোখ দু’টো জলে ভেসে যেতে লাগল। ছোট ভাইটা বারবার আঁচল দিয়ে মার চোখ মুছে দিতে লাগল। এক সময় নৌকো এসে ঘাটে ভিড়ল, আমরা সবাই নিরাপদে নানা বাড়ি পোঁছালাম। সীমান্তের ওপারে ছিল নানা বাড়ির গ্রামটা। এখানে এসে আমদের দিনটা বেশ ভালো কাটতে লাগল...
তারপর অনেক দিন কেটে গেল... আমার তো বেশ ভালো লাগছিলো... মার বকুনি নেই...বই নিয়ে বসার ঝমেলা নেই ...সারাদিন খেলাধূলা করতাম...হৈচৈ করতাম…
একসময় মামা এসে বলল, বাবার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা... যে সেক্টরের অধীনে বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল, সেখানে গতকাল প্রচুর গোলাগুলি হয়েছে, কয়েকজন আহত হয়েছে আর কয়েকজনকে পাক বাহিনী আটক করেছে।
এমনঅবস্থায় মা অঝরে কাঁদতে লাগল...
এভাবে কয়েকমাস কেটে গেল...
তারপর একদিন দেশ স্বাধীন হল... পরাধীনতার হাত হতে আমারা মুক্ত হলাম... আকাশে- বাতাসে তখন আনন্দের তোপধ্বনি ... কিন্তু বাবা আর ফিরে আসল না। মা, বাবার পথ চেয়ে বসে থাকল...
একসময় আমরা হাটি হাটি পা পা করে বেড়ে উঠলাম... স্কুল ছেড়ে কলেজ যাওয়া শুরু করলাম ... সময়ের সাথে জীবন বদলে গেল... পরিবারের চাপে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হলাম। সবকিছু আগের মত সুন্দর হলেও বাবা কিন্তু ফিরলনা।
হঠাৎ মেয়ের ডাকে চমকে ওঠে রেহনুমা খানম, চিন্তায় ছেদ পড়ে। অবচেতন মন এবার বাস্তব জগতে প্রবেশ করে। চারদিকে মাগরিবের আযান প্রতিধ্বনিত হয়...। নামায পড়ার জন্য ওঠে যান রেহনুমা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
০৫ আগষ্ট - ২০১৫
গল্প/কবিতা:
২৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।